প্রকাশ: বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৭:৫১ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
আত্মত্যাগ, অহংকার ও সাহসের স্মৃতি বহনকারী মাস ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের সালের এ মাসেই রচিত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় প্রাণ বিলিয়ে দেয়া শহীদদের প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় সর্বস্তরের জনতা। আজও অশুভের সঙ্গে আপোসহীন দ্বন্দ্বে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে ওঠা একুশের শহীদ মিনারই বাঙালির শপথ ও অঙ্গীকারের সার্বজনীন প্লাটফর্ম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় ঢাকা মেডিকেলের পেছনে আন্দোলনের গৌরব নিয়ে শহীদ মিনারকে আজ অহর্নিশ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি, এটি গড়ে ওঠার পর থেকে বার বার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে। আর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিয়েই বাঙালি বার বার গড়েছে এই চেতনার মিনার।
ভাষার দাবিতে প্রাণ হারানো শহীদদের স্মরণে প্রথম শহীদ মিনারটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। বর্তমানে যে জায়গায় শহীদ মিনারটি অবস্থিত তার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে প্রথম শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়েছিল (মেডিকেল হোস্টেলের ১২ নং শেডের পূর্ব প্রান্তে) হোস্টেলের মধ্যবর্তী রাস্তা ঘেঁষে কোণাকুণিভাবে। শহীদদের রক্তভেজা স্থানে নির্মিত সাড়ে ১০ ফুট উঁচু ও ৬ ফুট প্রস্থের এ ছোট স্থাপত্যটির নির্মাণকাজ শেষ হলে কাগজে ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ লিখে এর গায়ে সেঁটে দেওয়া হয়।
দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে এই মিনারের উদ্বোধন করেন। কিন্তু বিকেলে পুলিশ সেটি ভেঙে ফেলে। পরে ঢাকা কলেজেও একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়। কিন্তু সেটিও সরকারের নির্দেশে ভেঙ্গে ফেলা হয়। তবে ছোটখাট কিছু স্মৃতিস্তম্ভ দেশের আনাচে কানাচে গড়ে ওঠে।
১৯৫৩ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ঢাকা মেডিকেলের হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদ মিনারের শূন্য স্থানটিতে লাল কাগজের অবিকল প্রতিকৃতি স্থাপন করে তা কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এ শহীদ মিনার থেকেই শুরু হয় প্রথম প্রভাতফেরি।
যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসে ১৯৫৪ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ দিন ঘোষণা করা সরকারি ছুটি। আসে নতুন শহীদ মিনার তৈরির ঘোষণা আসে। ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন পূর্ববঙ্গ সরকারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার, মাওলানা ভাসানী এবং শহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগম।
শিল্পী হামিদুর রহমানের পরিকল্পনা ও নকশা অনুযায়ী ১৯৫৭ সালের নভেম্বর থেকে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু হয়। সহকর্মী ভাস্কর নভেরা আহমদকে সাথে নিয়ে তিনি মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে নির্মাণ কাজ আরম্ভ করেন। অসম্ভব নির্মাণশৈলী সমৃদ্ধ এ পরিকল্পনায় শহীদ মিনারের পাশে একটি জাদুঘর, পাঠাগার, ঝরণা ও ম্যুরাল নির্মাণেরও কথা ছিলো। অনেক দূর এগিয়েছিলো তার এ পরিকল্পনা। কিন্তু ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এ অসম্পূর্ণ ও খণ্ডিত শহীদ মিনারেই ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, শপথ গ্রহণ ও আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে।
১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আজম খানের নির্দেশে তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির পরামর্শ মতে মূল নকশা অনেকটাই পরিবর্তন ও সঙ্কুচিত করা হয়। মূল নকশাকে খণ্ডিত করে আরেকটি নকশা দাঁড় করানো হয়। এরপর দ্রুত মিনারের কাজ শেষ হয়। ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এর উদ্বোধন করেন বরকতের মা। এই মিনারই পরে একুশের চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনী মিনারটি ভেঙে সেখানে ‘মসজিদ’ লিখে দেয়। তবে দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে নতুন করে মিনার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এবারও মূল নকশা এড়িয়ে ১৯৬৩ সালের সংক্ষিপ্ত নকশার ভিত্তিতেই কাজ শেষ করা হয়। ১৯৭৬ সালে নতুন নকশা হলেও বাস্তবায়িত হয়নি। তবে ১৯৮৩ সালে মিনার চত্বর কিছুটা বিস্তার করে শহীদ মিনারটিকে বর্তমান অবস্থায় আনা হয়। সেই থেকে জাতি এখানেই শ্রদ্ধা জানায়।
বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মোট পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে। মাঝখানের স্তম্ভটি সবচেয়ে উঁচু এবং উপরের অংশটি সামনের দিকে নোয়ানো। এই উঁচু স্তম্ভটির দুই পাশে সমান ছোটো-বড় আরও চারটি স্তম্ভ। এর প্রতীকী তাৎপর্য হলো, অতন্দ্র প্রহরী চার সন্তানকে নিয়ে মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন মা। পেছনে উদীয়মান লাল টকটকে সূর্য। অর্থাৎ, মাতৃভাষার অধিকার, মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যেমন অকাতরে জীবন দিয়েছিল রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত। তেমনি মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব আর মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় মায়ের পাশে এখনও অতন্ত্র প্রহরায় তার সন্তানেরা। আর পেছনের লাল সূর্যটা স্বাধীনতার, নতুন দিনের, অন্ধকার দূর করে আলোর উৎসারণ।