শিরোনাম: |
গজারিয়া গণহত্যা
শিশুদের টেনে হিঁচড়ে বুটের নিচে ফেলে মাটির সঙ্গে পিষে মারে
আরিফ রহমান
|
![]() শিশুদের টেনে হিঁচড়ে বুটের নিচে ফেলে মাটির সঙ্গে পিষে মারে এই নয়টি গ্রাম ছাড়াও হানাদার বাহিনী গোসাইরচর খেয়াঘাটসংলগ্ন বিস্তীর্ণ চর ও ইসমানিরচর নদীর পাড়ে ব্যাপক গণহত্যা সংঘটন করে। এটি ছিল তৎকালীন মুন্সিগঞ্জ মহকুমায় হানাদার বাহিনীর প্রথম সামরিক অভিযান, যা গজারিয়া গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। কেবল ৮ মে মধ্যরাত থেকে ৯ মে ভোর পর্যন্ত এখানে ১১টি গণহত্যা সংঘটিত হয়। এটিই মুন্সিগঞ্জের সবচেয়ে বড় গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃত। ফুলদ নদী ঘেঁষা এই চরে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। ৮ মে গভীর রাতে বেলুচ রেজিমেন্টের প্রায় ২০০ সৈন্য একটি দোতলা লঞ্চ আর দুটি গানবোটে করে গজারিয়ায় আসে। ভোর বেলায় পুলিশ স্টেশন বরাবর ঘাটে এসে ভেড়ে হানাদারদের লঞ্চ। নদীর পাড়ে নেমে তারা পজিশন নেয়। মেঘনার পাড় থেকে বিরামহীনভাবে গুলির আওয়াজ শুনতে পায় এলাকার মানুষ। গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে তাদের। দিশাহারা মানুষজন প্রাণ বাঁচাতে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করে। যে যেদিকে পেরেছে পালানোর চেষ্টা করেছে। ঝোপঝাড়, বন বাদাড় ভেঙে কে কোথায় ছুটছে তার কোনো হিসাব নেই। কোন দিকটা নিরাপদ, তাও কেউ জানে না। তাদের একটাই কাজ, প্রাণপণে ছোটা। গুলির হাত থেকে নিজেকে বাঁচানো। কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই হানাদার বাহিনী গজারিয়া পুলিশ স্টেশন আক্রমণ করে। থানা দখলে নিয়ে তারা অপারেশনে নামে। হানাদাররা সাতটি গ্রুপে ভাগ হয়ে জালের মতো বেড়ি দিয়ে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। ফলে মানুষের পালানোর পথও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর হানাদার বাহিনী গ্রামে ঢুকে বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বেপরোয়াভাবে গুলি চালাতে থাকে। যাকে সামনে পায় গুলি করে। বুড়ো-জোয়ান কেউ বাদ যায়নি। শিশুদের টেনে হিঁচড়ে বুটের নিচে ফেলে মাটির সঙ্গে পিষে মারে। বুড়োদের রাইফেলের বাঁট দিয়ে মাথায় বাড়ি মেরে বুটের নিচে পায়ে ডলে মৃত্যু নিশ্চিত করে। যারা গুলিতে মরেনি, তাদের বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। একদল হত্যা করে চলে যায়, কিছুক্ষণ পর আরেক দল আসে কেউ বেঁচে গেল কি না দেখার জন্য। এভাবে তারা শতাধিক মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত করে। হানাদার বাহিনী গ্রাম থেকে অসহায় নারীদের ধরে এনে গোসাইরচর জামে মসজিদের পাশের একটি বীজাগারে গণধর্ষণ চালায়। নারীদের কোনো আকুতিই তাদের মন গলাতে পারেনি। এই গণহত্যায় ছাত্র-যুবক, কৃষক, বৃদ্ধ, দোকানদার, সরকারি কর্মচারী, মসজিদের ইমাম, মুসল্লি, পুরোহিত, নারী, কোলের শিশু থেকে আঁতুড় ঘরের শিশু-কেউ রেহাই পায়নি। দিনব্যাপী গণহত্যা চালিয়ে সন্ধ্যার আগে হানাদাররা ঢাকায় ফিরে যায়। রাতে চলে স্থানীয় দালালদের লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। এ সময় হানাদারদের স্থানীয় সহযোগীরা হিন্দুবাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে মানুষও খুন করে। গজারিয়া গ্রামের প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতা শামসুদ্দীন আহমেদ চৌধুরী (শ্যাম মিয়া), তার ছোট ভাই গজনবী আহমেদ চৌধুরী (খোকা মিয়া), একই বাড়ির আবদুল গফুর চৌধুরী ও আবদুল জলিল চৌধুরীসহ একটি মহল ছিল এই গণহত্যার কুশীলব। স্বাধীনতাবিরোধী এই দালালরা ঢাকা সেনানিবাসে খবর পাঠায় যে, নদীঘেরা এই গহীন জনপদে মুক্তিবাহিনীর আস্তানা গড়ে উঠেছে। মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা ও পাকিস্তানবিরোধী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েছে এখানকার মানুষ। দালালদের পাঠানো তিন দফা খবরের ভিত্তিতে এখানে গণহত্যা সংঘটিত হয়। মুন্সিগঞ্জ জেলায় সংগঠিত গণহত্যা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন সাহাদাত পারভেজ। তার জরিপে উঠে এসেছে নয় মাসে মুন্সিগঞ্জ জেলায় সংগঠিত গণহত্যার সংখ্যা ২৩৪টি। এসব গণহত্যায় কত মানুষ মারা গেছে? সঠিক তথ্য জানে না কেউ।
|
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |