মাথায় রয়েছে ওপর মহলের হাত। তাই আলোচিত মামলার আসামিরা পাচ্ছেন ভিআইপি সুবিধা। অসুস্থ থাকার কথা বলে হাসপাতালে শুয়ে-বসে কাটাচ্ছেন দিন। ক্যাসিনোকা-ে গ্রেফতার বিতর্কিত ঠিকাদার জিকে শামীমও বাদ যাননি এই সুবিধা থেকে। আট মাসের বেশি সময় রাজকীয় সেবা ভোগ করেছেন তিনি। যদিও সমালোচনার মুখে গতকাল বৃহস্পতিবার তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। দাগী এসব আসামিকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার নামে রাজকীয় বিলাস-ব্যসনে থাকার সুবিধা করে দেওয়ায় কারা ও সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নামে চলছে নানা সমালোচনা।
এসব প্রভাবশালী, আলোচিত আসামি অর্থ ও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে সব কিছু ‘ম্যানেজ’ করে এমন রাজকীয় সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছেন। অপরদিকে সাধারণ কয়েদিদের অনেকে প্রাপ্য চিকিৎসা সেবাটুকুও পাচ্ছেন না। গত ৫ এপ্রিল ডান হাতের চিকিৎসার জন্য কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জিকে শামীমকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) আনা হয়।
দু’দিনের মধ্যে চিকিৎসা সম্পন্ন করে তাকে ফের কারাগারে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু মাসের পর মাস কেটে গেলেও তাকে কারাগারে পাঠানো হয়নি। এরমধ্যে কারাগার থেকে জিকে শামীমকে ফেরত পাঠানোর জন্য বিএসএমএমইউতে বেশ কয়েকবার চিঠিও দেওয়া হয়। চিকিৎসার কথা বলে আট মাসের বেশি সময় ধরে বিএসএমএমইউতে থেকে যান একসময়কার প্রভাবশালী এই ঠিকাদার। হাসপাতালের প্রিজন্স অ্যানেক্স ভবনের ৪তলা ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি কক্ষে ভিআইপি হালে ছিলেন তিনি। পরে গতকাল বিকেলে বিএসএমএমইউ থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে কারাগারে ফেরত পাঠানো হয়। এর আগে জিকে শামীমের চিকিৎসা শেষ এবং তিনি সুস্থ আছেন বলে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। অথচ গত বছরের ২৭ অক্টোবর র্যাব-১ এর এসআই শেখর চন্দ্র মল্লিক সাত বডিগার্ডসহ জিকে শামীমের বিরুদ্ধে আদালতে অস্ত্র আইনের মামলায় চার্জশিট দাখিল করেন। এ মামলায় ইতোমধ্যেই আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বোচ্চ আদালত লম্বা কারাবাসের শাস্তি দিলেও অনেকেই অসুস্থতার নামে অনুমতি পেয়ে যান হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবার। সুযোগ মেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেম, হৃদরোগ ইনস্টিটিউটসহ নামীদামি হাসপাতালে রাজকীয় চিকিৎসা সেবার। সেখানে দিনের পর দিন মাসের পর মাস পান মোবাইল, রেডিও-টেলিভিশন-ফ্রিজ-এয়ার কন্ডিশে ব্যবহারের সুবিধা। সার্বক্ষণিক ডাক্তারও পেয়ে যান গন্ডায় গন্ডায়। ভিআইপিভাবে পেয়ে যান বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও। অথচ দ- পাওয়া এসব দাগি আসামি মাসের পর মাস নিবিড় চিকিৎসায় থেকেও সুস্থ হতে পারেন না! হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও দেন না কোনো ছাড়পত্র। ফলে কারাগারে না গিয়েই রাজসিক ভিআইপি সেবা গস্খহণ করেন তারা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া কারা অধিদপ্তরের মাসিক প্রতিবেদন বলছে, গত ডিসেম্বরে দেশজুড়ে মোট ১০৭ জন আসামি বা সাজাপ্রাপ্ত বন্দী চিকিৎসার জন্য কারাগারের বাইরে হাসপাতালে ছিলেন। কারা অধিদপ্তরের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র বলেছে, ঢাকার বাইরে ৬৫টি কারা হাসপাতালে চিকিৎসক নেই।
সেখানকার বন্দীদের চিকিৎসার জন্য বাইরের হাসপাতালে পাঠানোর এক ধরনের যুক্তি রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে যথাযথ চিকিৎসাব্যবস্থা। এরপরও ‘ভিআইপি বন্দি’রা চিকিৎসাসেবার নাম করে রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত হাসপাতালে অবস্থান করেন।
এ তালিকায় ছিলেন ক্যাসিনো-কা-ে গ্রেফতার যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট, টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের মামলার আসামি ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমিন ও ইয়াবা কারবারের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আমিন হুদাসহ প্রায় ৮০ জন আলোচিত প্রভাবশালী আসামি। সম্প্রতি সমালোচনার মুখে স¤্রাট, রফিকুল আমিন, আমিন হুদাসহ কয়েকজনকে কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ কারাগারে ফেরত নেওয়া হয়েছে জিকে শামিমকে। জানা গেছে এখনো কারাগারের বাইরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মো. ওহিদুল হক ও মো. আবদুল জলিল মিয়া ও বাংলাদেশ তাইওয়ান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান খাজা শাহাদাতসহ আরো অর্ধশতাধিক আলোচিত আসামি হাসপাতালে রাজসিক জীবন কাটাচ্ছেন।
জানা গেছে, বিএসএমএমইউ হাসপাতালের কারাকক্ষে চিকিৎসার নামে অবস্থান করছেন খাজা শাহাদাত। গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরার পর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তার মালামাল তল্লাশি করে প্রায় ১৩ কেজি সোনা পাওয়া গিয়েছিল। সোনা চোরাচালানের অভিযোগে ওই দিনই তার বিরুদ্ধে মামলাটি হয়। জানা গেছে, সরকারের এক ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীর সমর্থন রয়েছে তার প্রতি। খাজা শাহাদাত উল্লাহর জটিল কোনো রোগের কথা জানা যায়নি। কারাগারের কাগজপত্রে লেখা আছে, ‘মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ’। এর আগেও তিনি সাড়ে তিন মাস হাসপাতালে থেকে গেছেন। সে সময় কারাগারের কাগজপত্রে লেখা ছিল ‘ইনফেকশন, লো ব্যাক পেইন’।
একজন কারা চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এদের মধ্যে তিনজন আসলেই অসুস্থ। তাদেরকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের পরামর্শে। ঢাকা বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক টিপু সুলতান বলছেন, হাজতি ও কয়েদিদের চিকিৎসার প্রয়োজনে বাইরের হাসপাতালে পাঠানো হয়। তিনি বলেন, এর মধ্যে কোনো প্রভাব খাটানো বা অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয় নেই। কারাগারের সাবেক উপমহাপরিদর্শক গোলাম হায়দার বলেন, উচ্চপর্যায়ের দোহাই দিলে চলবে না। কারাবন্দীদের এভাবে টানা হাসপাতালে থাকাটা অস্বাভাবিক। কারা কর্তৃপক্ষের উচিত চিঠি দিয়ে হাসপাতাল থেকে আসামিদের ফেরত চাওয়া।